পরমাণুলোক
পরমাণুলোক
আমাদের সজীব দেহ কতকগুলি বোধের শক্তি নিয়ে জন্মেছে; যেমন দেখার বোধ, শোনার বোধ, ঘ্রাণের বোধ, স্বাদের বোধ, স্পর্শের বোধ। এইগুলিকে বলি অনুভূতি। এদের সঙ্গে
জড়িয়ে আছে আমাদের ভালো-মন্দ লাগা, আমাদের সুখদুঃখ।
আমাদের এই-সব
অনুভূতির সীমানা বেশি বড়ো নয়। আমরা কতদূরই বা দেখতে পাই, কতটুকু শব্দই বা শুনি। অন্যান্য বোধগুলিরও দৌড় বেশি নয়। তার মানে আমরা
যেটুকু বোধশক্তির সম্বল নিয়ে এসেছি সে কেবল এই পৃথিবীতেই আমাদের প্রাণ বাঁচিয়ে
চলার হিসাবমত। আরো কিছু বাড়তি হাতে থাকে। তাতেই আমরা পশুর কোঠা পেরিয়ে মানুষের
কোঠায় পৌঁছতে পারি।
যে নক্ষত্র থেকে এই
পৃথিবীর জন্ম, যার জ্যোতি এর প্রাণকে পালন করছে সে হচ্ছে সূর্য। এই
সূর্য আমাদের চার দিকে আলোর পর্দা টাঙিয়ে দিয়েছে। পৃথিবীকে ছাড়িয়ে জগতে আর যে
কিছু আছে তা দেখতে দিচ্ছে না। কিন্তু দিন শেষ হয়, সূর্য অস্ত যায়, আলোর ঢাকা যায় সরে; তখন অন্ধকার ছেয়ে বেরিয়ে পড়ে অসংখ্য নক্ষত্র।
বুঝতে পারি জগৎটার সীমানা পৃথিবী ছাড়িয়ে অনেক দূরে চলে গেছে। কিন্তু কতটা যে
দূরে তা কেবল অনুভূতিতে ধরতে পারি নে।
সেই দূরত্বের সঙ্গে
আমাদের একমাত্র যোগ চোখের দেখা দিয়ে। সেখান থেকে শব্দ আসে না, কেননা, শব্দের বোধ হাওয়ার থেকে। এই হাওয়া চাদরের মতোই
পৃথিবীকে জড়িয়ে আছে। এই হাওয়া পৃথিবীর মধ্যেই শব্দ জাগায়, এবং শব্দের ঢেউ চালাচালি করে। পৃথিবীর বাইরে ঘ্রাণ আর স্বাদের কোনো অর্থই নেই।
আমাদের স্পর্শবোধের সঙ্গে আমাদের আর-একটা বোধ আছে— ঠাণ্ডা-গরমের বোধ।
পৃথিবীর বাইরের সঙ্গে আমাদের এই বোধটার অন্তত এক জায়গায় খুবই যোগ আছে। সূর্যের
থেকে রোদ্দুর আসে, রোদ্দুর থেকে পাই গরম। সেই গরমে আমাদের প্রাণ।
সূর্যের চেয়ে লক্ষ গুণ গরম নক্ষত্র আছে। তার তাপ আমাদের বোধে পৌঁছয় না। কিন্তু
সূর্যকে তো আমাদের পর বলা যায় না। অন্য যে-সব অসংখ্য নক্ষত্র নিয়ে এই
বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, সূর্য তাদের মধ্যে সকলের চেয়ে আমাদের আত্মীয়। তবু
মানতে হবে, সূর্য পৃথিবীর থেকে আছে দূরে। কম দূরে নয়, প্রায় ন’কোটি ত্রিশ লক্ষ মাইল তার দূরত্ব। শুনে চমকে উঠলে
চলবে না। যে ব্রহ্মাণ্ডে আমরা আছি এখানে ঐ দূরত্বটা নক্ষত্রলোকের সকলের চেয়ে
নীচের ক্লাসের। কোনো নক্ষত্রই ওর চেয়ে পৃথিবীর কাছে নেই।
এই-সব দূরের কথা
শুনে আমাদের মনে চমক লাগে তার কারণ জলে মাটিতে তৈরি এই পিণ্ডটি— এই পৃথিবী— অতি ছোটো। পৃথিবীর
দীর্ঘতম লাইনটি অর্থাৎ তার বিষুবরেখার কটিবেষ্টন ঘুরে আসবার পথ প্রায় পঁচিশ হাজার
মাইল মাত্র। বিশ্বের পরিচয় যতই এগোবে ততই দেখতে পাবে জগতের বৃহত্ত্ব বা দূরত্বের
ফর্দে এই পঁচিশ হাজার সংখ্যাটা অত্যন্ত নগণ্য। পূর্বেই বলেছি আমাদের বোধশক্তির
সীমা অতি ছোটো। সর্বদা যেটুকু দূরত্ব নিয়ে আমাদের কারবার করতে হয় তা কতটুকুই বা।
ঐ সামান্য দূরত্বটুকুর মধ্যেই আমাদের দেখার আমাদের চলাফেরার বরাদ্দ নির্দিষ্ট।
কিন্তু পর্দা যখন
উঠে গেল তখন আমাদের অনুভূতির সামান্য সীমানার মধ্যেই বৃহৎ বিশ্ব নিজেকে নিতান্ত
ছোটো করে একটুখানি আভাসে জানান দিলে, তা না হলে জানা হতই
না, কেননা, বড়ো দেখার চোখ আমাদের
নয়। অন্য জীবজন্তুরা এইটুকু দেখাই মেনে নিলে। যতটুকু তাদের অনুভূতিতে ধরা দিল
ততটুকুতেই তারা সন্তুষ্ট হল। মানুষ হল না। ইন্দ্রিয়বোধে জিনিসটার একটূ ইশারা
মাত্র পাওয়া গেল। কিন্তু মানুষের বুদ্ধির দৌড় তার বোধের চেয়ে আরো অনেক বেশি, জগতের সকল দৌড়ের সঙ্গেই সে পাল্লা দেবার স্পর্ধা রাখে। সে এই প্রকাণ্ড জগতের
প্রকাণ্ড মাপের খবর জানতে বেরল, অনুভূতির
ছেলেভুলোনো গুজব দিলে বাতিল করে। ন’কোটি ত্রিশ লক্ষ
মাইলকে আমরা কোনোমতেই অনুভব করতে পারি নে, কিন্তু বুদ্ধি হার
মানলে না, হিসেব কষতে বসল।
বাইরের বিশ্বলোকটার
কথা থাক্, আমরা যে পৃথিবীতে আছি, তার চেয়ে কাছে তো
আর কিছুই নেই, তবু এর সমস্তটাকে এক করে দেখা আমাদের বোধের পক্ষে
অসম্ভব। কিন্তু একটি ছোটো গ্লোবে যদি তার ম্যাপ আঁকা দেখি, তা হলে পৃথিবীর সমগ্রটাকে জানার একটুখানি গোড়াপত্তন হয়। আয়তন হিসাবে
গ্লোবটি পৃথিবীর অনেক-হাজার ভাগের একভাগমাত্র। আমাদের অন্য-সব বোধ বাদ দিয়ে
কেবলমাত্র দৃষ্টিবোধের আঁচড়কাটা পরিচয় এতে আছে। বিস্তারিত বিবরণ হিসাবে, এ একেবারে ফাঁকা। বেশি দেখবার শক্তি আমাদের নেই বলেই ছোটো করেই দেখাতে হল।
প্রতিরাত্রে
বিশ্বকে এই-যে ছোটো করেই দেখানো হয়েছে সেও আমাদের মাথার উপরকার আকাশের গ্লোবে।
দৃষ্টিবোধ ছাড়া অন্য কোনো বোধ এর মধ্যে জায়গা পায় না। যা চিন্তা করতে মন অভিভূত
হয়ে যায় এত বড়ো জিনিসকে দিক-সীমানায় বদ্ধ এই আকাশটুকুর মধ্যে আমাদের কাছে ধরা
হল।
কতই ছোটো করে ধরা
হয়েছে তার একটুখানি আন্দাজ পেতে হলে সূর্যের দৃষ্টান্ত মনে আনতে হবে। স্বভাবতই
আমরা যত-কিছু বড়ো জিনিসকে জানি বা মনে আনতে পারি তার মধ্যে সব চেয়ে বড়ো এই
পৃথিবী। একে আমরা অংশ অংশ করেই দেখতে পারি। একসঙ্গে সবটার প্রকৃত ধারণা আমাদের
বোধের পক্ষে অসম্ভব। অথচ সূর্য এই পৃথিবীর চেয়ে প্রায় তেরো লক্ষ গুণ বড়ো।
এতবড়ো সূর্য আকাশের একটা ধারে আমাদের কাছে দেখা দিয়েছে একটি সোনার থালার মতো।
সূর্যের ভিতরকার সমস্ত তুমুল তোলপাড়ের যখন খবর পাই আর তার পরে যখন দেখি ভোরবেলায়
আমাদের আমবাগানের পিছন থেকে সোনার গোলকটি ধীরে ধীরে উপরে উঠে আসছে, জীবজন্তু গাছপালা আনন্দিত হয়ে উঠছে,তখন মনে ভাবি
আমাদের কিরকম ভুলিয়ে রাখা হয়েছে— আমাদের বলে দিয়েছে ‘তোমাদের জীবনের কাজে এর বেশি জানবার কোনো দরকার নেই।’ না ভোলালেই বা বাঁচতুম কী করে। ঐ সূর্য আপন বিরাট স্বরূপে যা, সে যদি আমাদের অনুভূতির অল্পমাত্রও কাছে আসত তা হলে তো আমরা মুহূর্তেই লোপ
পেয়ে যেতুম। এই তো গেল সূর্য। এই সূর্যের চেয়ে আরো অনেক গুণ বড়ো আছে আরো অনেক
অনেক নক্ষত্র। তাদের দেখছি কতকগুলি আলোর ফুটকির মতো। যে-দূরত্বের মধ্যে এই-সব
নক্ষত্র ছড়ানো, ভেবে তার কিনারা পাওয়া যায় না। বিশ্বজগতের বাসা যে
আকাশটাতে সেটা যে কত বড়ো সে কথা আর-একদিক থেকে ভেবে দেখা যেতে পারে। আমাদের
তাপবোধে পৃথিবীর বাইরে থেকে একটা খুব বড়ো খবর খুব জোরের সঙ্গে এসে পৌঁচচ্ছে, সে হচ্ছে রৌদ্রের উত্তাপ। এ খবরটা ন’কোটি ত্রিশ লক্ষ
মাইল দূরের। কিন্তু ঐ তো আকাশে আকাশে আছে বহুকোটি নক্ষত্র, তাদের মধ্যে কোনো-কোনোটি সূর্যের চেয়ে বহুগুণ বেশি উত্তপ্ত। কিন্তু আমাদের
ভাগ্যগুণে তাদের সম্মিলিত গরম পথেই এতটা মারা গেল যে বিশ্বজোড়া অগ্নিকাণ্ডে
আমাদের আকাশটা দুঃসহ হল না। কত দূরের এই পথ, কত প্রকাণ্ড এই
আকাশ। তাপের অনুভূতিকে স্পর্শ করা ন’কোটি মাইল তার কাছে
তুচ্ছ। বড়ো যজ্ঞের রান্নাঘরে যে চুলি জ্বলছে তার কাছে বসা আরামের নয়, কিন্তু বেলা দশটার কাছাকাছি শহরের সমস্ত রান্নাঘরে যে আগুন জ্বলে বড়ো আকাশে
তা ছড়িয়ে যায় বলেই শহরে বাস করতে পারি। নক্ষত্রলোকের ব্যাপারটাও সেইরকম।
সেখানকার আগুনের ঘটা যতই প্রচণ্ড হোক, তার চার দিকের
আকাশটা আরো অনেক প্রকাণ্ড।
এই বিরাট দূরত্ব
থেকে নক্ষত্রদের অস্তিত্বের খবর এনে দিচ্ছে কিসে। সহজ উত্তর হচ্ছে আলো। কিন্তু আলো
যে চুপচাপ বসে খবর আউড়িয়ে যায় না, আলো যে ডাকের
পেয়াদার মতো খবর পিঠে করে নিয়ে দৌড়ে চলে, বিজ্ঞানের এক একটা
মস্ত আবিষ্কার। চলা বলতে সামান্য চলা নয়, এমন চলা
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আর কোনো দূতেরই নেই। আমরা ছোটো পৃথিবীর মানুষ, তাই এতকাল জগতের সব চেয়ে বড়ো চলার কথাটা জানবার সুযোগ পাই নি। একদিন
বিজ্ঞানীদের অত্যাশ্চর্য হিসাবের কলে ধরা পড়ে গেল, আলো চলে সেকেণ্ডে
এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল বেগে। এমন একটা বেগ যা অঙ্কে লেখা যায়, মনে আনা যায় না। বুদ্ধিতে যার পরীক্ষা হয়, অনুভবে হয় না।
আলোর এই চলনের দৌড় অনুভবে বুঝব, এই পৃথিবীটুকুতে এত
বড়ো জায়গা পাব কোথায়। এইটুকুর মধ্যে ওর চলাকে আমরা না-চলার মতোই দেখে আসছি। পরখ
করবার মতো স্থান পাওয়া যায় মহাশূণ্যে। সূর্য আছে সেই মহাশূণ্যের যে দূরত্বমাত্রা
নিয়ে, সে যত কোটি মাইল হোক জ্যোতিষ্কলোকের দূরত্বের
মাপকাঠিতে খুব বেশি নয়।
সুতরাং এইকুটু
দূরত্বের মধ্যে অপেক্ষাকৃত ছোটো মাপে মানুষ আলোর দৌড় দেখতে পেল। খবর মিলল যে, এই শূণ্য পেরিয়ে সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসে প্রায় সাড়ে আট মিনিটে। অর্থাৎ
আমাদের দৃষ্টির পাল্লায় সূর্য যখন উপস্থিত, আসলে তার আগেই সে
এসেছে। এই আগমনের খবরটি জানাতে আলো-নকিবের মিনিট আষ্টেক দেরি হল। এইটুকু দেরিতে
বিশেষ কিছু আসে যায় না। প্রায় তাজা খবরই পাওয়া গেছে। কিন্তু সৌরজগতের সব চেয়ে
কাছে আছে যে নক্ষত্র, অর্থাৎ নক্ষত্রমহলে যাকে আমাদের পাড়াপড়শি বললে চলে, যখন সে জানান দিল ‘এই-যে আছি’ তখন তার সেই বার্তা
বয়ে আনতে আলোর সময় লাগছে চার বছরের কাছাকাছি। অর্থাৎ এইমাত্র যে খবর পাওয়া গেল
সেটা চার বছরে বাসি। এইখানে দাঁড়ি টানলেই যথেষ্ট হত, কিন্তু আরো দূরের নক্ষত্র আছে যেখান থেকে আলো আসতে বহু লক্ষ বছর লাগে।
আকাশে আলোর এই
চলাচলের খবর বেয়ে বিজ্ঞানে একটা প্রশ্ন উঠল, তার চলার ভঙ্গিটা
কিরকম। সেও এক আশ্চর্য কথা। উত্তর পাওয়া গেছে, তার চলা অতি
সূক্ষ্ম ঢেউয়ের মতো। কিসের ঢেউ সে কথা ভেবে পাওয়া যায় না; কেবল আলোর ব্যবহার থেকে এটা মোটামুটি জানা গেছে-ওটা ঢেউ বটে। কিন্তু মানুষের
মনকে হয়রান করবার জন্যে সঙ্গে সঙ্গেই একটা জুড়ি খবর তার সমস্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ
নিয়ে হাজির হল, জানিয়ে দিলে আলো অসংখ্য জ্যোতিষ্কণা নিয়ে; অতি খুদে ছিটেগুলির মতো ক্রমাগত তার বর্ষণ। এই দুটো উল্টো খবরের মিলন হল কোন্খানে
তা ভেবে পাওয়া যায় না। এর চেয়েও আশ্চর্য একটা পরস্পর-উল্টো কথা আছে, সে হচ্ছে এই যে বাইরে যেটা ঘটছে সেটা একটা-কিছু ঢেউ আর বর্ষণ, আর ভিতরে আমরা যা পাচ্ছি তা, না-এটা, না-ওটা, তাকে আমরা বলি আলো— এর মানে কী, কোনো পণ্ডিত তা বলতে পারলেন না।
যা ভেবে ওঠা যায়
না, যা দেখাশোনার বাইরে, তার এত সূক্ষ্ম এবং
এত প্রকাণ্ড খবর পাওয়া গেল কী করে, এ প্রশ্ন মনে আসতে
পারে। নিশ্চিত প্রমাণ আছে, আপাতত এ কথা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। যাঁরা
প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন অসাধারণ তাঁদের জ্ঞানের তপস্যা, অত্যন্ত দুর্গম তাঁদের সন্ধানের পথ। তাঁদের কথা যাচাই করে নিতে যে
বিদ্যাবুদ্ধির দরকার, তাও আমাদের অনেকের নেই। অল্প বিদ্যা নিয়ে অবিশ্বাস
করতে গেলে ঠকতে হবে। প্রমাণের রাস্তা খোলাই আছে। সেই রাস্তায় চলবার সাধনা যদি কর, শক্তি যদি হয়, তবে একদিন এ-সব বিষয় নিয়ে সওয়ালজবাব সহজেই হতে
পারবে।
আপাতত আলোর ঢেউয়ের
কথাই বুঝে নেওয়া যাক। এই ঢেউ একটিমাত্র ঢেউয়ের ধারা নয়। এর সঙ্গে অনেক ঢেউ দল
বেঁধেছে। কতকগুলি চোখে পেড়, অনেকগুলি পড়ে না।
এইখানে বলে রাখা ভালো, যে আলো চোখে পড়ে না, চলতি ভাষায় তাকে
আলো বলে না; কিন্তু দৃশ্যই হোক অদৃশ্যই হোক একটা-কোনো শক্তির এই
ধরনের ঢেউখেলিয়ে চলাই যখন উভয়ের স্বভাব তখন বিশ্বতত্ত্বের বইয়ে ওদের পৃথক নাম
অসংগত। বড়োভাই নামজাদা, ছোটোভাইকে কেউ জানে না, তবু বংশগত ঐক্য ধরে
উভয়েরই থাকে একই উপাধি, এও তেমনি।
আলোর ঢেউয়ের আপন
দলের আরো একটি ঢেউ আছে, সেটা চোখে দেখি নে, স্পর্শে বুঝি। সেটা
তাপের ঢেউ। সৃষ্টির কাছে তার খুবই প্রতাপ। এমনিতরো আলোর-ঢেউজাতীয় নানা পদার্থের
কোনোটা দেখা যায়, কোনোটা স্পর্শে বোঝা যায়; কোনোটাকে স্পষ্ট আলোরূপে জানি আবার সঙ্গে সঙ্গেই তাপরূপেও বুঝি; কোনোটাকে দেখাও যায় না, স্পর্শেও পাওয়া
যায় না। আমাদের কাছে প্রকাশিত অপ্রকাশিত
আলোতরঙ্গের ভিড়কে যদি এক নাম দিতে হয়, তবে তাকে তেজ বলা
যেতে পারে। বিশ্বসৃস্টির আদি অন্তে মধ্যে প্রকাশ্যে আছে বা লুকিয়ে আছে বিভিন্ন
অবস্থায় এই তেজের কাঁপন। পাথর হোক লোহা হোক বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় তাদের মধ্যে
কোনো নড়াচড়া নেই। তারা যেন স্থিরত্বের আদর্শস্থল। কিন্তু এ কথা প্রমাণ হয়ে গেছে
যে তাদের অণু পরমাণু, অর্থাৎ অতি সূক্ষ্ম পদার্থ, যাদের দেখতে পাই নে অথচ যাদের মিলিয়ে নিয়ে এরা আগাগোড়া তৈরি, তারা সকল সময়েই ভিতরে ভিতরে কাঁপছে। ঠাণ্ডা যখন থাকে তখনো কাঁপছে, আর কাঁপুনি যখন আরো চড়ে ওঠে তখন গরম হয়ে বাইরে থেকেই ধরা পড়ে আমাদের
বোধশক্তিতে। আগুনে পোড়ালে লোহার পরমাণু কাঁপতে কাঁপতে এত বেশি অস্থির হয়ে ওঠে যে
তার উত্তেজনা আর লুকানো থাকে না। তখন কাঁপনের ঢেউ আমাদের শরীরের স্পর্শনাড়ীকে ঘা
মেরে তার মধ্য দিয়ে যে খবরটা চালিয়ে দেয় তাকে বলি গরম। বস্তুত গরমটা আমাদের
মারে। আলো মারে চোখে, গরম মারে গায়ে।
ছেলেবেলায় যখন
একদিন মাস্টারমশায় দেখিয়ে দিলেন লোহার টুকরো আগুনে তাতিয়ে প্রথমে হয় গরম, তার পরে হয় লাল টক্টকে, তার পরে হয় সাদা
জ্বল্জ্বলে,বেশ মনে আছে তখন আমাকে এই কথা নিয়ে ভাবিয়েছিল যে, আগুন তো কোনো-একটা দ্রব্য নয় যেটা লোহার সঙ্গে বাইরে থেকে মিশিয়ে লোহাকে
দিয়ে এমনতরো চেহারা বদল করাতে পারে। তার পরে আজ শুনছি আরো তাপ দিলে এই লোহাটা
গ্যাস হয়ে যাবে। এ-সমস্তই জাদুকর তাপের কাণ্ড, সৃষ্টির আরম্ভ থেকে
আজ পর্যন্ত চলেছে।
সূর্যের আলো সাদা।
এই সাদা রঙে মিলিয়ে আছে সাতটা বিভিন্ন রঙের আলো। যেন সাতরঙের রশ্মির পেখম, গুটিয়ে ফেললে দেখায় সাদা, ছড়িয়ে ফেললে
দেখায় সাতরঙা। সেকালে ছিল ঝাড়লণ্ঠন, বিজলিবাতির তাড়ায়
তারা হয়েছে দেশছাড়া। এই ঝাড়ের গায়ে দুলত তিনপিঠওয়ালা কাঁচের পরকলা। এইরকম
তিনপিঠওয়ালা কাঁচের গুণ এই যে, ওর ভিতর দিয়ে রোদ্দুর
এলে তার থেকে সাত রঙের আলো ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে। পরে পরে রঙ বিছানো হয়; বেগনি ( Violet), অতিনীল ( Indigo), নীল ( Blue ), সবুজ (Green), হলদে (Yellow), নারঙি (Orange), আর লাল ( Red)। এই সাতটা রঙ চোখে দেখা যায় কিন্তু এদের দুই প্রান্তের বাইরে তেজের আরো অনেক
ছোটো-বড়ো ঢেউ আছে, তারা আমাদের সহজ চেতনায় ধরা দেয় না। সেই জাতের যে
ঢেউ বেগনি রঙের পরের পারে তাকে বলে ultra-violet
light, সহজ ভাষায় বলা যাক বেগনি-পারের আলো। আর যে আলো লালের এলাকায় এসে পৌঁছয় নি, রয়েছে তার আগের পারে তাকে বলে infra-red light, আমরা বলতে পারি
লাল-উজানি আলো। স্যর উইলিয়ম হার্শল ছিলেন এক মস্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানী। তিনপিঠওয়ালা
কাঁচের মধ্য দিয়ে তিনি পরীক্ষা করে দেখেছিলেন আলোর সাতরঙা ছটা। কালোরঙ-করা
তাপ-মাপের নল নিয়ে এক-একটা রঙের কাছে ধরে দেখলেন। লালরঙের দিকে উত্তাপ ধীরে ধীরে
বাড়তে লাগল। লাল পেরিয়ে নলটিকে নিয়ে গেলেন বেরঙা অন্ধকারে, সেখানেও গরম থামতে চায় না। বোঝা গেল আরো আলো আছে ঐ অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে।
তার পর এলেন এক জর্মন রসায়নী। একটা ফোটোগ্রাফির প্লেট নিয়ে পরীক্ষায় লাগলেন। এই
প্লেটে লাল থেকে বেগনি পর্যন্ত সাতটা রঙের সাড়া পাওয়া গেল। শেষে বেগনি পেরিয়ে
চললেন অন্ধকারে, সেখানে চোখে যা ধরা দেয় না প্লেটে তা ধরা পড়ল। দেখা
গেল আলোর উত্তাপটা লালরঙের দিকে, আর রাসায়ণিক
ক্রিয়া বেগনি পারের দিকে। এক কালে মনে হয়েছিল অ-দেখারা রঙিন দলেরই পার্শ্বচর, অন্ধকারে পড়ে গেছে। যত এগোতে লাগল গুপ্ত আলোর সন্ধান, ততই সাতরঙা দলেরই আসন হল খাটো। বিজ্ঞানের জরীপে আলোর সীমানা আজ সাতরঙ রাজার
দেশ ছাড়িয়ে গেছে শতগুণ। লাল-উজানি আলোর দিকে ক্রমে আজ দেখা দিল যে ঢেউ সেই ঢেউ
বেয়ে চলে আকাশবাণী, যাকে বলে রেডিয়ো-বার্তা; বেগনি-পারের দিকে প্রকাশ পেল বিখ্যাত র্যা ন্টগেন আলো, যে-আলোর সাহায্যে দেহের চামড়ার ঢাকা পেরিয়ে ভিতরকার হাড় দেখতে পাওয়া যায়।
আলো জিনিসটাতে কেবল
যে নক্ষত্রের অস্তিত্বের খবর দেয় তা নয়, ওদের মধ্যে কোন্
কোন্ পদার্থ মিলিয়ে আছে, মানুষ সে খবরও আলোর যেন বুক চিরে আদায় করে নিয়েছে।
কেমন করে আদায় হল বুঝিয়ে বলা যাক।
তিনপিঠওয়ালা
কাঁচের ভিতর দিয়ে সূর্যের সাদা আলো পার করলে তার সাতটা রঙের পরিচয় পরে পরে
বেরিয়ে পড়ে। লোহা প্রভৃতি শক্ত জিনিস যথেষ্ট তেতে জ্বলে উঠলে তার আলো যখন ক্রমে
সাদা হয়ে ওঠে তখন এই সাদা আলো ভাগ করলে সাত রঙের ছটা পাশাপাশি দেখা যায়। তাদের
মাঝে মাঝে কোনো ফাঁক থাকে না কিন্তু লোহাকে গরম করতে করতে যখন তা গ্যাস হয়ে যায়
তখন ঐ কাঁচের ভিতর দিয়ে তার আলো ভাঙলে বর্ণচ্ছটায় একটানা পাই নে। দেখা যায়
আলাদা আলাদা উজ্জ্বল রেখা, তাদের মধ্যে মধ্যে থাকে আলোহীন ফাঁকা জায়গা। এই
বর্ণালোক-চিহ্নপাতের নাম দেওয়া যাক বর্ণলিপি।
এই লিপিতে দেখা
গেছে দীপ্ত গ্যাসীয় অবস্থায় প্রত্যেক জিনিসের আলোর বর্ণচ্ছটা স্বতন্ত্র। নুনের
মধ্যে সোডিয়ম-নামক এক মৌলিক পদার্থ পাওয়া যায়। তাপ দিয়ে দিয়ে তাকে গ্যাস করে
ফেললে বর্ণলিপিতে তার আলোর মধ্যে খুব কাছাকাছি দেখা যায় দুটি হলদে রেখা। আর-কোনো
রঙ পাই নে। সোডিয়ম ছাড়া অন্য কোনো জিনিসেরই বর্ণচ্ছটায় ঠিক ঐ জায়গাতেই ঐ দুটি
রেখা মেলে না। ঐ দুটি রেখা যেখানকারই গ্যাসের বর্ণলিপিতে দেখা যাবে বুঝব সোডিয়ম
আছেই।
কিন্তু দেখা যায়
সূর্যের আলোর বর্ণচ্ছটায় সোডিয়ম গ্যাসের ঐ দুটি উজ্জ্বল হলদে রেখা চুরি গেছে, তার জায়গায় রয়েছে দুটো কালো দাগ। বিজ্ঞানী বলেন উত্তপ্ত কোনো গ্যাসীয়
জিনিসের আলো সেই গ্যাসেরই অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা স্তরের ভিতর দিয়ে আসার সময় সম্পূর্ণ
শোষিত হয়। এ ক্ষেত্রে আলোর অভাবেই যে কালো দাগের সৃষ্টি তা নয়। বস্তুত সূর্যের
বর্ণমণ্ডলে যে সোডিয়ম গ্যাস সূর্যের আলো আটক করে সেও আপন উত্তাপ অনুযায়ী আলো
ছড়িয়ে দেয়, আলোকমণ্ডলের তুলনায় উত্তাপ কম বলে এর আলো হয় অনেকটা
ম্লান। এই ম্লান আলো বর্ণচ্ছটায় উজ্জ্বল আলোর পাশে কালোর বিভ্রম জন্মায়।
মৌলিক জিনিস
মাত্রেরই আলো ভেঙে প্রত্যেকটির বর্ণচ্ছটার ফর্দ তৈরি হয়ে গেছে। এই বর্ণভেদের
সঙ্গে তুলনা করলেই বস্তুভেদ ধরা পড়বে তা সে যেখানেই থাক্, কেবল গ্যাসীয় অবস্থায় থাকা চাই।
পৃথিবী থেকে যে
৯২টি মৌলিক পদার্থের খবর পাওয়া গেছে সূর্যে তার সবগুলিরই থাকা উচিত; কেননা, পৃথিবী সূর্যেরই দেহজাত। প্রথম পরীক্ষায় পাওয়া
গিয়েছিল ৩৬টি মাত্র জিনিস। বাকিগুলির কী হল সেই প্রশ্নের মীমাংসা করছেন বাঙালি
বিজ্ঞানি মেঘনাদ সাহা। নূতন সন্ধানপথ বের করে পরে সূর্যে আরো কতকগুলি মৌলিক জিনিস
তিনি ধরতে পেরেছেন। তাঁর পথ বেয়ে প্রায় সবগুলিরই খবর মিলেছে। আজও যেগুলি
গরঠিকানা মাঝপথেই পৃথিবীর হাওয়া তাদের সংবাদ শুষে নেয়।
সব রঙ মিলে সূর্যের আলো সাদা, তবে কেন নানা
জিনিসের নানা রঙ দেখি। তার কারণ সব জিনিস সব রঙ নিজের মধ্যে নেয় না, কোনো-কোনোটাকে বিনা ওজরে বাইরে বিদায় করে দেয়। সেই ফেরত-দেওয়া রঙটাই আমাদের
চোখের লাভ। মোটা ব্লটিং যে রসটা শুষে ফেলে সে কারো ভোগে লাগে না, যে রসটা সে নেয় না সেই উদ্বৃত্ত রসটাই আমাদের পাওনা। এও তেমনি। চুনি পাথর
সূর্যকিরণের আর-সবরকম ঢেউকেই মেনে নেয়, ফিরিয়ে দেয় লাল
রঙকে। তার এই ত্যাগের দানেই চুনির খ্যাতি। যা নিজে আত্মাসাৎ করেছে তার কোনো খ্যাতি
নেই। লাল রঙটাই কেন যে ও নেয় না আর নীল রঙের ‘পরেই নীলা পাথরের
কেন সম্পূর্ণ বৈরাগ্য এ প্রশ্নের জবাব ওদের পরমাণু-মহলে লুকানো রইল। সূর্যের সব
ঢেউকেই পাকা-চুল ফিরে পাঠায় তাই সে সাদা, কাঁচা-চুল কোনো
ঢেউই ফিরে দেয়না, অর্থাৎ আলোর কোনো অংশই তার কাছ থেকে ছাড়া পায় না, তাই সে কালো। জগতের সব জিনিসই যদি সূর্যের সব রঙই করত আত্মাসাৎ তা হলে সেই
কৃপণের জগৎটা দেখা দিত কালো হয়ে, অর্থাৎ দেখাই দিত
না। যেন খবর বিলোবার সাতটা পেয়াদাকেই পোস্টমাস্টার বন্ধ করে রাখত। অথচ কোনো আলোই
যদি না নিত সবই হত সাদা, তবে সেই একাকারে সব জিনিসেরই প্রভেদ যেত ঘুচে। যেন
সাতটা পেয়াদার সব চিঠিই তাল পাকিয়ে একখানা করা হত, কোনো স্বতন্ত্র
খবরই পাওয়া যেত না। একই চেহারায় সবাইকে দেখাকে দেখা বলে না। না-আলো আর পূর্ণ-আলো
কোনোটাতেই আমাদের দেখা চলে না, আমরা দেখি
ভাঙা-আলোর মেলামেশায়।
সূর্যকিরণের সঙ্গে
জড়ানো এমন অনেক ঢেউ আছে, যারা অতি অল্প পরিমাণে আসে বলে অনুভব করতে পারি নে।
এমন ঢেউও আছে যারা প্রচুর পরিমাণেই নেমে আসে, কিন্তু পৃথিবীর
বায়ুমণ্ডল তাদের আটক করে। নইলে জ্বলে পুড়ে মরতে হত। সূর্যের যে পরিমাণ দান আমরা
সইতে পারি প্রথম থেকেই তাই নিয়ে আমাদের দেহতন্ত্রের বোঝাপড়া হয়ে গেছে। তাই
বাইরে আমাদের জীবনযাত্রার কারবার বন্ধ।
বিশ্বছবিতে সব
চেয়ে যা আমাদের চোখে পড়ে সে হল নক্ষত্রলোক, আর সূর্য, সেও একটা নক্ষত্র। মানুষের মনে এতকাল এরা প্রাধান্য পেয়ে এসেছে। বর্তমান যুগে
সব চেয়ে মানুষকে আশ্চর্য করে দিয়েচে এই বিশ্বের ভিতরকার লুকানো বিশ্ব, যা অতি সূক্ষ্ম, যা চোখে দেখা যায় না, অথচ যা সমস্ত
সৃষ্টির মূলে।
একটা মাটির ঘর নিয়ে যদি পরখ করে বের করতে চাই তার গোড়াকার জিনিসটা কী, তা হলে পাওয়া যাবে ধুলোর কণা। যখন তাকে আর গুঁড়ো করা চলবে না তখন বলব এই অতি
সূক্ষ্ম ধুলোই মাটির ঘরের আদিম মালমসলা। তেমনি করেই মানুষ একদিন ভেবেছিল, বিশ্বের পদার্থগুলিকে ভাগ করতে করতে যখন এমন সূক্ষ্মে এসে ঠেকবে যে তাকে আর
ভাগ করা যাবে না তখন সেইটেকেই বলব বিশ্বের আদিভূত, অর্থাৎ গোড়াকার
সামগ্রী। আমাদের শাস্ত্রে তাকে বলে পরমাণু, য়ুরোপীয় শাস্ত্রে
বলে অ্যাটম। এরা এত সূক্ষ্ম যে দশকোটি পরমাণুকে পাশাপাশি সাজালে তার মাপ হবে এক
ইঞ্চি মাত্র।
সহজ উপায়ে ধুলোর
কণাকে আর আমরা ভাগ করতে পারি নে কিন্তু বৈজ্ঞানিক তাড়নে বিশ্বের সকল সামগ্রীকে
আরো অনেক বেশি সূক্ষ্মে নিয়ে যেতে পেরেছে। শেষকালে এসে ঠেকেছে বিরেনব্বইটা অমিশ্র
পদার্থে। পণ্ডিতেরা বললেন এদেরই যোগ-বিয়োগে জগতের যতকিছু জিনিস গড়া হয়েছে, এদের সীমান্ত পেরোবার জো নেই।
মনে করা যাক, মাটির ঘরের এক অংশ তৈরি খাঁটি মাটি দিয়ে, আর-এক অংশ মাটিতে
গোবরে মিলিয়ে। তা হলে দেয়াল গুঁড়িয়ে দুরকম জিনিস পাওয়া যাবে, এক বিশুদ্ধ ধুলোর কণা, আর-এক ধুলোর সঙ্গে মেশানো গোবরের গুঁড়ো। তেমনি
বিশ্বের সব জিনিস পরখ করে বিজ্ঞানীরা তাদের দুই শ্রেণীতে ভাগ করেছেন, এক ভাগের নাম মৌলিক, আর-এক ভাগের নাম যৌগিক। মৌলিক পদার্থে কোনো মিশল নেই, আর যৌগিক পদার্থে এক বা আরো বেশি জিনিসের যোগ আছে। সোনা মৌলিক, ওকে সাধারণ উপায়ের যত সূক্ষ্ম ভাগ কর সোনা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যাবে না। জল
যৌগিক, ওকে ভাগ করলে দুটো মৌলিক গ্যাস বেরিয়ে পড়ে, একটার নাম অক্সিজেন আর-একটার নাম হাইড্রোজেন। এই দুটি গ্যাস যখন স্বতন্ত্র
থাকে তখন তাদের একরকমের গুণ, আর যেই তারা মিশে
হয় জল, তখনই তাদের আর চেনবার জো থাকে না, তাদের মিলনে সম্পূর্ণ নূতন স্বভাব উৎপন্ন হয়। যৌগিক পদার্থ মাত্রেরই এই দশা।
তারা আপনার মধ্যে আপন আদিপদার্থের পরিচয় গোপন করে। যা হোক এই-সব অ্যাটম
পদবিওয়ালারাই একদিন খ্যাতি পেয়েছিল জগতের মূল উপাদান বলে; সবাই বলেছিল, এদের ধাতে আর একটুও ভাগ সয় না। কিন্তু শেষকালে তারও
ভাগ বেরল। যাকে পরমাণু বলা হয়েছে তাকেও ভাঙতে ভাঙতে ভিতরে পাওয়া গেল অতিপরমাণু— সে এক অপরূপ জিনিস, তাকে জিনিস বলতেও মুখে বাধে। বুঝিয়ে বলা যাক।
আজকাল ইলেক্ট্রিসিটি শব্দটা খুব চলতি— ইলেক্ট্রিক বাতি, ইলেক্ট্রিক মশাল, ইলেক্ট্রিক পাখা এমন আরো কত কী। সকলেরই জানা আছে ওটা একরকমের তেজ। এও সবাই
জানে মেঘের মধ্যে থেকে আকাশে চমক দেয় সেই বিদ্যুৎও ইলেক্ট্রিসিটি ছাড়া আর কিছু নয়। এই বিদ্যুৎই পৃথিবীতে আমাদের কাছে সব চেয়ে প্রবল প্রতাপে
ইলেক্ট্রিসিটি কে, আলোয় এবং গর্জনে ঘোষণা করে। গায়ে লাগলে সাংঘাতিক
হয়ে ওঠে। ইলেক্ট্রিসিটি শব্দটাকে আমরা
বাংলায় বলব বৈদ্যুত।
এই বৈদ্যুত আছে দুই
জাতের। বিজ্ঞানীরা এক জাতের নাম দিয়েছেন পজিটিভ, আর-এক জাতের নাম
নেগেটিভ। তর্জমা করলে দাঁড়ায় হাঁ-ধর্মী আর না-ধর্মী। এদের মেজাজ পরস্পরের উলটো, এই বিপরীতকে মিলিয়ে দিয়ে হয়েছে সমস্ত যা-কিছু। অথচ পজিটিভের প্রতি পজিটিভের, নেগেটিভের প্রতি নেগেটিভের একটা স্বভাবগত বিরুদ্ধতা আছে,এদের টানটা বিপরীত পক্ষের দিকে।
এই দুই জাতের অতি
সূক্ষ্ম বৈদ্যুতকণা জোট বেঁধেছে পরমাণুতে। এই দুই পক্ষকে নিয়ে প্রত্যেক পরমাণু
যেন গ্রহে সূর্যে মিলন-বাঁধা। সৌরমণ্ডলের মতো। সূর্য যেমন সৌরলোকের কেন্দ্রে থেকে
টানের লাগামে ঘোরাচ্ছে পৃথিবীকে, পজিটিভ বৈদ্যুতকণা
তেমনি পরমাণুর কেন্দ্রে থেকে টান দিচ্ছে নেগেটিভ কণাগুলোকে, আর তারা সার্কাসের ঘোড়ার মতো লাগামধারী পজিটিভের চার দিকে ঘুরছে।
পৃথিবী ঘুরছে
সূর্যের চার দিকে নয় কোটি মাইলের দূরত্ব রক্ষা করে। আয়তনের তুলনায় অতিপরমাণুদের
কক্ষপথের দূরত্ব অনুপাতে তার চেয়ে বেশি বৈ কম নয়। পরমাণু যে অণুতম আকাশ অধিকার
করে আছে তার মধ্যেও দূরত্বের প্রভূত কম-বেশি আছে। ইতিপূর্বে নক্ষত্রলোকে
বৃহত্ত্বের ও পরস্পর-দূরত্বের অতি প্রকাণ্ডতার কথা বলেছি, কিন্তু অতি ছোটোকেও বলা যেতে পারে অতি প্রকাণ্ড ছোটো। বৃহৎ প্রকাণ্ডতার সীমাকে
সংখ্যাচিহ্ন দিয়ে ঘের দিতে গেলে যেমন একের পিছনে বিশ-পঁচিশটা অঙ্কপাত করতে হয়
ক্ষুদ্রতম প্রকাণ্ডতা সম্বন্ধে সেই একই কথা। তারও সংখ্যারও ফৌজ লম্বা লাইন জুড়ে
দাঁড়ায়। পরমাণুর অতি সূক্ষ্ম আকাশে যে দূরত্ব বাঁচিয়ে অতিপরমাণুরা চলাফেরা করে
তার উপমা উপলক্ষে একজন বিখ্যাত জ্যোতিষী বলেছেন, হাওড়া স্টেশনের
মতো মস্ত একটা স্টেশন থেকে অন্য সব-কিছু জিনিস সরিয়ে দিয়ে কেবল গোটা পাঁচ-ছয়
বোলতা ছেড়ে দিলে তবে তারই সঙ্গে তুলনা হতে পারে পরমাণু আকাশস্থিত অতিপরমাণুদের। কিন্তু এই ব্যাপক শূণ্যের মধ্যে দূরবর্তী কয়েকটি
চঞ্চল পদার্থকে আটকে রাখবার জন্যে পরমাণুর কেন্দ্রবস্তুর প্রায় সমস্ত ভার সমস্ত
শক্তি কাজ করছে। এ না হলে পরমাণুজগৎ ছারখার হয়ে যেত, আর পরমাণু দিয়ে গড়া বিশ্বজগতের অস্তিত্ব থাকত না।
পদার্থের মধ্যে
অণুগুলি পরস্পর কাছাকাছি আছে একটা টানের শক্তিতে। তবু সোনার মতো নিরেট জিনিসের
অণুরও মাঝে মাঝে ফাঁক আছে। সংখ্যা দিয়ে সেই অতি সূক্ষ্ম ফাঁকের পরিমাণ জানাতে চাই
নে, তাতে মন পীড়িত হবে। প্রশ্ন ওঠে একটুও ফাঁক থাকে কেন, গ্যাস থাকে কেন, কেন থাকে তরল পদার্থ। এর একই জাতের প্রশ্ন হচ্ছে
পৃথিবী কেন সূর্যের গায়ে গিয়ে এঁটে যায় না। সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড একটা পিণ্ডে
তাল পাকিয়ে যায় না কেন। এর উত্তর এই পৃথিবী সূর্যের টান মেনেও দৌড়ের বেগে তফাত
থাকতে পারে। দৌড় যদি যথেষ্ট পরিমাণ বেশি হত তা হলে টানের বাঁধন ছিঁড়ে শূণ্যে
বেরিয়ে পড়ত, দৌড়ের বেগ যদি ক্লান্ত হত তা হলে সূর্য তাকে নিত
আত্মাসাৎ করে। অণুদের মধ্যে ফাঁক থেকে যায় গতির বেগে, তাতেই বাঁধনের শক্তিকে ঠেলে রেখে দেয়। গ্যাসীয় পদার্থে গতির প্রাধান্য বেশি।
অণুর দল এই অবস্থায় এত দ্রুতবেগে চলে যে তাদের পরস্পরের মিল ঘটবার অবকাশ থাকে না।
মাঝে মাঝে তাদের সংঘাত হয় কিন্তু মুহূর্তেই আবার যায় সরে। তরল পদার্থে আণবিক
আকর্ষণের শক্তি সামান্য বলেই চলন বেগের জন্যে তাদের মধ্যে অতিঘনিষ্ঠতার সুযোগ হয়
না। নিরেট বস্তুতে বাঁধনের শক্তিটা অপেক্ষাকৃত প্রবল। তাতে অণুর দল সীমাবদ্ধ
স্থানের ভিতর আটকা পড়ে থাকে। তাই বলে তারা যে শান্ত থাকে তা নয়; তাদের মধ্যে কম্পন চলছেই, কিন্তু তাদের
স্বাধীনতার ক্ষেত্র অল্পপরিসর।
অণুদের মধ্যে এই
চলন কাঁপন, এই হচ্ছে তাপ। অস্থিরতা যত বাড়ে গরম ততই স্পষ্ট হয়ে
ওঠে। এদের একেবারে শান্ত করা সম্ভব হত যদি এদের তাপ তাপমানের শূণ্য অঙ্কের নীচে
আরো ২৭৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড নামিয়ে দেওয়া সম্ভব হত।
এইবার হাইড্রজেন
গ্যাসের পরমাণু মহলে দৃষ্টি দেওয়া যাক।
এর চেয়ে হালকা
গ্যাস আর নেই। এর পরমাণুর কেন্দ্রে বিরাজ করছে একটিমাত্র বৈদ্যুতকণা যাকে বলে
প্রোটন, আর তার টানে বাঁধা পড়ে চার দিকে ঘুরছে অন্য
একটিমাত্র কণিকা যার নাম ইলেক্ট্রন। প্রোটন-কণায় যে বৈদ্যুতের প্রভাব সে
পজিটিভধর্মী, আর ইলেক্ট্রন-কণা যে বৈদ্যুতের বাহন সে নেগেটিভধর্মী।
নেগেটিভ ইলেক্ট্রন চটুল
চঞ্চল, পজিটিভ প্রোটন রাশভারী। ইলেক্ট্রনের ওজনটা গণ্যের মধ্যেই নয়, পরমাণুর প্রায়
সমস্ত ভার কেন্দ্রবস্তুতে হয়েছে জমা।
মোটের উপরে সব ইলেক্ট্রনই না-ধর্মী বটে, কিন্তু এমন একজাতের ইলেক্ট্রন ধরা পড়েছে যারা হাঁ-ধর্মী, অথচ ওজনে ইলেক্ট্রনেরই সমান।এদের নাম দেওয়া হয়েছে পজিট্রন।
কখনো কখনো দেখা
গেছে বিশেষ হাইড্রজেনের পরমাণু সাধারণের চেয়ে ডবল ভারী। পরীক্ষায় বেরিয়ে পড়ল
কেন্দ্রস্থলে প্রোটনের সঙ্গে আছে তার এক সহযোগী। পূর্বেই বলেছি প্রোটন হাঁ-ধর্মী।
তার কেন্দ্রের শরিকটিকে পরখ করে দেখা গেল সে সাম্যধর্মী, হাঁ-ধর্মীও নয়, না-ধর্মীও নয়। অতএব সে বৈদ্যুতধর্ম-বর্জিত। সে আপন
প্রোটন শরিকের সমান ওজনের, কিন্তু প্রোটন যেমন করে ইলেক্ট্রনকে টানে এ তেমন টানতে পারে না, আবার প্রোটনকে ঠেলে
ফেলবার চেষ্টাও তার নেই। এই কণার নাম দেওয়া হয়েছে ন্যুট্রন। এটি লক্ষ্য করে দেখা
গিয়েছে অন্য জাতের বাটখারা দিয়ে পরমাণু যতই ভারী করা যাক ইলেক্ট্রনের উপরে
সেই সাম্যধর্মীদের কোনো জোর খাটে না— একটি প্রোটন কেবল একটিমাত্র ইলেক্ট্রনকে শাসনে
রাখে। পরমাণুকেন্দ্রে প্রোটনের সংখ্যা যে পরিমাণ বেশি হয় সেই পরিমাণ ইলেক্ট্রনকে তারা বশে রাখে। অক্সিজেন গ্যাসের পরমাণুকেন্দ্রে আছে আটটি প্রোটন, সঙ্গে থাকে আটটি ন্যুট্রন, তার প্রদক্ষিণকারী ইলেক্ট্রনের
সংখ্যা ঠিক আটটি।
পজিটিভ নেগেটিভে
যথাপরিমাণ মিলে যেখানে সন্ধি করে আছে সেখানে যদি কোনো উপায়ে গৃহবিচ্ছেদ ঘটানো
যায়, গুটিকতক নেগেটিভকে দেওয়া যায় তফাত করে, তা হলে সেই জিনিসে বৈদ্যুতের পরিমাণের হিসাবে হবে গরমিল, অতিরিক্ত হয়ে পড়বে পজিটিভ বৈদ্যুতের চার্জ। মেয়েপুরুষে মিলে যেখানে
গৃহস্থালীর সামঞ্জস্য যেখানে মেয়ের প্রভাবকে যে পরিমাণে সরিয়ে দেওয়া যাবে, সে-সংসারটা সেই পরিমাণে হয়ে পড়বে পুরুষপ্রধান; এও তেমনি।
এই চার্জ কথাটা
ইলেক্ট্রিসিটির প্রসঙ্গে সর্বদাই ব্যবহারে লাগে। সাধারণত যে-সব জিনিস নিয়ে
নাড়াচাড়া করি তাদের মধ্যে বৈদ্যুতের কোনো ছট্ফটানি দেখা যায় না, তারা চার্জ করা নয়, অর্থাৎ দুই জাতের যে-পরিমাণ বৈদ্যুতে মিলে মিশে থাকলে
শান্তি রক্ষা হয় তা তাদের মধ্যে আছে। কিন্তু কোনো জিনিসে কোনো একটা জাতের বৈদ্যুত
যদি সন্ধি না মেনে আপন নির্দিষ্ট পরিমাণ ছাপিয়ে বাড়াবাড়ি করে তা হলে সেই
বৈদ্যুতের দ্বারা জিনিসটা চার্জ করা হয়েছে বলা হয়।
এক টুকরো রেশম
নিয়ে কাঁচের গায়ে ঘষা গেল। ফল হল এই যে ঘষড়ানিতে কাঁচের থেকে কিছু ইলেক্ট্রন এল বেরিয়ে, সেটা চালান হল রেশমে। কাঁচে নেগেটিভ কমতেই পজিটিভ
বৈদ্যুতের প্রাধান্য হল, ওদিকে রেশমে নেগেটিভ বৈদ্যুতের প্রভাব বাড়ল, সেটা হল নেগেটিভ বৈদ্যুতের দ্বারা চার্জ করা। ইলেক্ট্রন-খোয়ানো
কাঁচ তার পজিটিভ চার্জের ঝোঁকে টেনে নিতে চাইল রেশমটাকে, আবার নেগেটিভের ভিড়-বাহুল্যওয়ালা রেশমে টান পড়ল কাঁচের দিকে। কাঁচ বা রেশমে
সাধারণতন্ত্র যখন অক্ষুণ্ন ছিল তখন আপনাতে আপনি ছিল সহজ, ছিল শান্ত। শান্ত অবস্থায় এদের মধ্যে বৈদ্যুতের অস্তিত্ব জানাই যায় নি।
বাইরে বৈদ্যুতিক গৃহবিপ্লবের খবর তখনই বেরিয়ে পড়ল যেমনি ভাগাভাগি অসমানতায়
ক্ষোভ জন্মিয়ে দিলে।
কাঁচ কিংবা
অন্য-কিছুর থেকে ঘষাঘষির দ্বারা সামান্য পরিমাণ ইলেক্ট্রন সরিয়ে নেবার কথা
বলেছি। পরিমাণটা কত যদি বিজ্ঞানীকে জিজ্ঞাসা করা যায় তিনি সামান্য একটু ঘাড়
নেড়ে বলবেন, ঘষড়ানির মাত্রা অনুসারে চল্লিশ পঞ্চাশ ষাট কোটি হতে
পারে। বিজলি বাতির সল্তে-তারের ভিতর দিয়ে ইলেক্ট্রনের
ঠেসাঠেসি ভিড় চলতে থাকে,তবেই সে জ্বলে। তারে এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে
যতগুলি ইলেক্ট্রন একসঙ্গে
যাত্রা করে আমাদের গণিতশাস্ত্রে সেই সংখ্যার কী নাম আছে আমি তা তো জানি নে।যা হোক
এটা দেখা গেল যে, অতিপরমাণুদের দুরন্ত চাঞ্চল্য পজিটিভ নেগেটিভে সন্ধি
করে সংযত হয়ে আছে তাই বিশ্বে আছে শান্তি। ভালুকওয়ালা বাজায় ডুগডুগি, তারই তালে ভালুক নাচে, আর নানা খেলা দেখায়। ডুগডুগিওয়ালা না যদি থাকে, পোষমানা ভালুক যদি শিকল কেটে স্বধর্ম পায় তাহলে কামড়িয়ে আঁচড়িয়ে চার দিকে
অনর্থপাত করতে থাকে। আমাদের সর্বাঙ্গে এবং দেহের বাইরে এই পোষমানা বিভীষিকা নিয়ে
অদৃশ্য ডুগডুগির ছন্দে চলেছে সৃষ্টির নাচ ও খেলা। সৃষ্টির আখড়ায় দুই খেলোয়াড়
তাদের ভীষণ দ্বন্দ্ব মিলিয়ে বিশ্বচরাচরের রঙ্গভূমি সরগরম ক’রে রেখেছে।
কোনো কোনো বিজ্ঞানী
পরমাণুজগৎকে সৌরমণ্ডলীর সঙ্গে তুলনীয় করে বললেন, পরমাণুর কেন্দ্র
ঘিরে ভিন্ন ভিন্ন চক্রপথে ঘুর খাচ্ছে ইলেক্ট্রনের দল।
আর-এক পণ্ডিত প্রমাণ করলেন যে, ঘুর্ণিপাক-খাওয়া ইলেক্ট্রনরা তাদের
এক কক্ষপথ থেকে আর-এক কক্ষপথে ঠাঁই বদল করে, আবার ফেরে আপন
নির্দিষ্ট পথে।
পরমাণুলোকের যে-ছবি সৌরলোকের ছাঁদে, তাতে আছে পজিটিভ
বৈদ্যুতওয়ালা একটা কেন্দ্রবস্তু, আর তার চার দিকে ইলেক্ট্রনদের প্রদক্ষিণ।
এ মত মেনে নেবার
বাধা আছে। ইলেক্ট্রন যদি একটানা পথে চলত তা হলে ক্রমে তার
শক্তি ক্ষয় হয়ে ক্রমে পথ খাটো করে সে পড়ত গিয়ে কেন্দ্রবস্তুর উপরে। পরমাণুর
সর্বনাশ ঘটাত।
এখন এই মত
দাঁড়িয়েছে, ইলেক্ট্রনের ডিম্বাকার চলবার পথ একটি নয়, একাধিক। কেন্দ্র থেকে এই কক্ষগুলির দূরত্ব নির্দিষ্ট। কেন্দ্রের সব চেয়ে কাছের
যে পথ, কোনো ইলেক্ট্রন তা
পেরিয়ে যেতে পারে না। ইলেক্ট্রন বাইরের
পথ থেকে ভিতরের পথে দর্শন দেয়। কেন দেয় এবং হঠাৎ কখন দেখা দেবে তার কোনো বাঁধা
নিয়ম পাওয়া যায় না। তেজ শোষণ করে ইলেক্ট্রন ভিতরের
পথ থেকে বাইরের পথে লাফিয়ে যায়, এই লাফের মাত্রা
নির্ভর করে শোষিত তেজের পরিমাণের উপর। ইলেক্ট্রন তেজ বিকীর্ণ করে কেবল যখন সে তার বাইরের পথ থেকে ভিতরের পথে আবির্ভূত হয়। ছাড়া-পাওয়া এই তেজকেই
আমরা পাই অলোরূপে। যতক্ষণ একই কক্ষে চলতে থাকে ততক্ষণ তার শক্তি-বিকিরণ বন্ধ। এ
মতটা ধরে-নেওয়া একটা মত, কোনো কারণ দেখানো যায় না। মতটা মেনে নিলে তবেই বোঝা
যায় পরমাণু কেন টিঁকে আছে, বিশ্ব কেন বিলুপ্ত হয়ে যায় নি।
এই-সব কথার পিছনে দুরূহ তত্ত্ব আছে, সেটা বোঝবার অনেক
দেরি।আপাতত কথাটা শুনে রাখা মাত্র।
পূর্বেই বলেছি
বিজ্ঞানীরা খুব দৃঢ়স্বরে ঘোষণা করেছিলেন যে, বিরেনব্বইটি
আদি-ভূত বিশ্বসৃষ্টির মৌলিক পদার্থ। অতিপরমাণুদের সাক্ষ্যে আজ সে কথা অপ্রমাণ হয়ে
গেল। তবু এখনো রয়ে গেল এদের সম্মানের উপাধিটা।
একদা মৌলিক
পদার্থের খ্যাতি ছিল যে তাদের গুণের নিত্যতা আছে। তাদের যতই ভাঙা যাক কিছুতেই
তাদের স্বভাবের বদল হয় না। বিজ্ঞানের প্রথম অধ্যয়ে দেখা গেল তাদের চরম ভাগ করলে
বেরিয়ে পড়ে দুই জাতীয় বৈদ্যুতওয়ালা কণাবস্তুর জুড়িনৃত্য। যারা ‘মৌলিক পদার্থ’ নামধারী তাদের স্বভাবের বিশেষত্ব রক্ষা করেছে এই-সব
বৈদ্যুতেরা বিশেষ সংখ্যায় একত্র হয়ে। এইখানেই যদি থামত তা হলেও পরমাণুদের
রূপনিত্যতার খ্যাতি টিঁকে যেত। কিন্তু ওদের নিজের দলের থেকেই বিরুদ্ধে সাক্ষ্য
পাওয়া গেল। একটা খবর পাওয়া গেল যে, হালকা যে-সব পরমাণু
তাদের মধ্যে ইলেক্ট্রন প্রোটনের ঘোরাঘুরি নিত্যনিয়মিতভাবে চলে
আসছে বটে কিন্তু অত্যন্ত ভারী যারা, যাদের মধ্যে
ন্যুট্রন-প্রোট্রনসংঘের অতিরিক্ত ঠেসাঠেসি ভিড়, যেমন য়ুরেনিয়ম বা
রেডিয়ম, তারা আপন তহবিল সামলাতে পারছে না— সদাসর্বক্ষণই তাদের মূল সম্বল ছিটকে পড়তে পড়তে হাল্কা হয়ে তারা এক রূপ
থেকে অন্য রূপ ধরছে।
এতকাল রেডিয়ম-নামক
এক মৌলিক নামক এক মৌলিক ধাতু লুকিয়ে ছিল স্থূল আবরণের মধ্যে। তার আবিষ্কারের
সঙ্গে সঙ্গে পরমাণুর গূঢ়তম রহস্য ধরা পড়ে গেল। বিজ্ঞানীদের সঙ্গে তার প্রথম
মোকাবিলার ইতিহাস মনে রেখে দেবার যোগ্য।
যখন র্যন্ট্গেন রশ্মির আবিষ্কার হল,দেখা গেল তার স্থূল
বাধা ভেদ করবার ক্ষমতা। তখন আঁরি বেকরেল ছিলেন প্যারিস ম্যুনিসিপাল স্কুলে বিজ্ঞানের
অধ্যাপক। স্বতোদীপ্তিমান পদার্থ মাত্রেরই এই বাধা ভেদ করবার শক্তি আছে কি না, সেই পরীক্ষায় তিনি লাগলেন। এইরকম কতকগুলি ধাতুপদার্থ নিয়ে কাজ আরম্ভ করে
দিলেন। তাদের কালো কাগজে মুড়ে রেখে দিলেন ফোটোগ্রাফের প্লেটের উপরে। দেখলেন তাতে
মোড়ক ভেদ করে কেবল য়ুরেনিয়ম ধাতুরই চিহ্ন পড়ল। সকলের চেয়ে গুরুভার যার পরমাণু
তার তেজষ্ক্রিয়তা সপ্রমাণ হয়ে গেল।
পিচ্ব্লেন্ড্-নামক
এক খনিজ পদার্থ থেকে য়ুরেনিয়মকে ছিনিয়ে নেওয়া থাকে। বেকরেলের এক অসামান্য
বুদ্ধিদীন্ত ছাত্রী ছিলেন মাদাম কুরি। তাঁর স্বামী পিয়ের কুরি ফরাসী বিজ্ঞানী
বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। তাঁরা স্বামী-স্ত্রীতে মিলে এই পিচব্লেন্ড্ নিয়ে পরখ
করতে লাগলেন, দেখলেন এর তেজষ্ক্রিয় প্রভাব য়ুরেনিয়মের চেয়ে আরো
প্রবল। পিচব্লেন্ডের মধ্যে এমন কোনো কোনো পদার্থ আছে যারা এই শক্তির মূলে, তারই আবিষ্কারের চেষ্টায় তিনটি নূতন পদার্থ বের হল, রেডিয়ম, পলোনিয়ম, এবং অ্যাক্টিনিয়ম।
পরীক্ষা করতে করতে প্রায় চল্লিশটি তেজষ্ক্রিয় পদার্থ পাওয়া গেছে। প্রায়
এদের সবগুলিই বিজ্ঞানে নতুন-জানা।
তখনকার দিনে সকলের
চেয়ে চমক লাগিয়ে দিল এই ধাতুর একটি অদ্ভূত স্বভাব। সে নিজের মধ্যে থেকে
জ্যোতিষ্কণা বিকীর্ণ করে নিজেকে নানা মৌলিক পদার্থে রূপান্তরিত করতে করতে অবশেষে
সীসে করে তোলে। এ যেন একটা বৈজ্ঞানিক ভেলকি বললেই হয়। এক ধাতু থেকে অন্য ধাতুর যে
উদ্ভব হতে পারে, সে এই প্রথম জানা গেল।
যে-সকল পদার্থ
রেডিয়মের এক জাতের, অর্থাৎ তেজ-ছিটোনোই যাদের স্বভাব তারা সকলেই
জাত-খোয়াবার দলে। তারা কেবলই আপনার তেজের মূলধন খরচ করতে থাকে। এই অপব্যয়ের
ফর্দে প্রথম যে তেজঃপদার্থ পড়ে, গ্রীকবর্ণমালার
প্রথম অক্ষরের নামে তার নাম দেওয়া হয়েছে আল্ফা। বাংলা বর্ণমালা ধরে তাকে ক
বললেই চলে। এ একটা পরমাণু, পজিটিভ জাতের। রেডিয়মের আরো একটা ছিটিয়ে-ফেলা তেজের
কণা আছে, তার নাম দেওয়া হয়েছে বীটা, বলা যেতে পারে খ। সে ইলেক্ট্রন, নেগেটিভ চার্জ করা, বিষম তার দ্রুত বেগ। তবু পাতলা একটি কাগজ চলার রাস্তায় পড়লে আল্ফা-পরমাণু
দেহান্তর লাভ করে, সে হয়ে যায় হীলিয়ম গ্যাস। আরো কিছু বাধা লাগে
বীটাকে থামিয়ে দিতে। রেডিয়মের তূণে এই দুইটি ছাড়া আর-একটি রশ্মি আছে তার নাম
গামা। সে পরমাণু বা অতিপরমাণু নয়, সে একটি বিশেষ
আলোকরশ্মি। তার কিরণ স্থুল বস্তুকে ভেদ করে যেতে পারে, যেমন যায় র্যন্ট্গেন রশ্মি। এই-সব তেজকণার ব্যবহার সকল অবস্থাতেই সমান– লোহা-গলানো গরমেও, গ্যাস-তরল-করা ঠাণ্ডাতেও। তা ছাড়া তাদের ফিরিয়ে
নিয়ে আবার পূর্বের মতো দানা বেঁধে দেওয়া কারো সাধ্য নেই।
পরমাণুর কেন্দ্র-পিণ্ডটিকে যতক্ষণ-না কোনো লোকসান ঘটে ততক্ষণ দুটো-চারটে ইলেক্ট্রন যদি ছিনিয়ে নেওয়া যায় তা হলে তার বৈদ্যুতের বাঁধা বরাদ্দে কিছু
কমতি পড়তে পারে কিন্তু অপঘাতটা সাংঘাতিক হয় না। যদি ঐ কেন্দ্রবস্তুটার খাস
তহবিলে লুটপাট সম্ভব হয় তা হলেই পরমাণুর জাত বদল হয়ে যায়।
পরমাণুর নিজের
একান্ত ঐক্য নেই এ-খবরটা পেয়েই বিজ্ঞানীরা প্রথমটা আশা করেছিলেন যে, তাঁরা তেজ-ছুঁড়ে-মারা গোলন্দাজ রেডিয়মকে লাগাবেন পরমাণুর মধ্যে ভেদ ঘটিয়ে
তার কেন্দ্রসম্বলভাঙা লুটপাটের কাজে। কিন্তু লক্ষ্যটি অতিসূক্ষ্ম, নিশানা করা সহজ নয়, তেজের ঢেলা বিস্তর মারতে মারতে দৈবাৎ একটা লেগে যায়।
তাই এরকম অনিশ্চিত লড়াই-প্রণালীর বদলে আজকাল প্রকাণ্ড যন্ত্র তৈরির আয়োজন হচ্ছে
যাতে অতি প্রচণ্ড শক্তিমান বৈদ্যুত উৎপন্ন হয়ে পরমাণুর কেন্দ্রকেল্লার পাহারা ভেদ
করতে পারে। সেখানে আছে প্রবল পালোয়ান-শক্তির পাহারা। আজ ঠিক যে-সময়টাতে লক্ষ
লক্ষ মানুষ মারবার জন্যে সহস্রঘ্নী যন্ত্রের উদ্ভাবন হচ্ছে ঠিক সেই সময়টাতেই বিশ্বের
সূক্ষ্মতম পদার্থের অলক্ষ্যতম মর্ম বিদীর্ণ করবার জন্যে বিরাট বৈদ্যুতবর্ষণীর
কারখানা বসল।
পূর্বেই বলেছি আল্ফাকণা
স্বরূপ হারিয়ে হয়ে যায় হীলিয়ম গ্যাস। এটা কাজে লেগেছে পৃথিবীর বয়স প্রমাণ
করতে। কোনো পাহাড়ের একখানা পাথরের মধ্যে যদি বিশেষ পরিমাণ হীলিয়ম গ্যাস দেখা
যায়, তা হলে এই গ্যাসের পরিণতির নির্দিষ্ট সময় হিসাব করে
ঐ পাহাড়ের জন্মকুষ্ঠি তৈরি করা যায়। এই প্রণালীর ভিতর দিয়ে পৃথিবীর বয়স বিচার
করা হয়েছে।
ওজনের গুরুত্বে
হাইড্রজেন গ্যাসের ঠিক উপরের কোঠাতেই পড়ে যে-গ্যাস তারই নাম দেওয়া হয়েছে হীলিয়ম।
এই গ্যাস বিজ্ঞানীমহলে নূতন-জানা। এই গ্যাস প্রথম ধরা পড়েছিল সূর্যগ্রহণের সময়ে।
সূর্য আপন চক্রসীমাটুকু ছাড়িয়ে বহুলক্ষ ক্রোশ দূর পর্যন্ত জলদ্বাষ্পের অতি
সূক্ষ্ম উত্তরীয় উড়িয়ে থাকে, ঝরনা যেমন জলকণার
কুয়াশা ছড়ায় আপনার চারি দিকে। গ্রহণের সময় সেই তার চার দিকের আগ্নেয় গ্যাসের
বিস্তার দেখতে পাওয়া যায় দুরবীনে। এই দূরবিক্ষিপ্ত গ্যাসের দীপ্তিকে য়ুরোপীয়
ভাষায় বলে করোনা, বাংলায় একে বলা যেতে পারে কিরীটিকা।
কিছুকাল আগে ১৯৩৭ খৃষ্টাব্দের সূর্যগ্রহণের সুযোগে এই কিরীটিকা পরীক্ষা করবার
সময় বর্ণলিপির নীলসীমানার দিকে দেখা গেল তিনটি অজানা সাদা রেখা। পণ্ডিতেরা ভাবলেন
হয়তো কোনো একটি আগের জানা পদার্থ অধিক দহনে নূতন দশা পেয়েছে, এটা তারই চিহ্ন। কিংবা হয়তো একটা নতুন পদার্থই বা জানান দিল। এখনো তার ঠিকানা
হল না।
১৮৬৮ খৃষ্টাব্দের
গ্রহণের সময় বিজ্ঞানীদের এইরকমই একটা চমক লাগিয়েছিল— সূর্যের গ্যাসীয় বেড়ার ভিতর থেকে একটা লিপি এল তখনকার কোনো অচেনা পদার্থের।
এই নূতন খবর-পাওয়া মৌলিক পদার্থের নাম দেওয়া হল হীলিয়ম, অর্থাৎ সৌরক। কেননা তখন মনে হয়েছিল এটা একান্ত সূর্যেরই অন্তর্গত গ্যাস।
অবশেষে ত্রিশ বছর কেটে গেলে পরে বিখ্যাত রসায়নী র্যা ম্ইজে এই গ্যাসের আমেজ
পেলেন পৃথিবীর হাওয়ায় অতি সামান্য পরিমাণে। তখন স্থির হল পৃথিবীতে এ গ্যাস
দুর্লভ। তার পরে দেখা গেল উত্তর-আমেরিকায় কোনো মেটে তেলের গহ্বরে যে-গ্যাস পাওয়া
যায় তাতে যথেষ্ট পরিমাণে হীলিয়ম আছে। তখন একে কাজে লাগাবার সুবিধে হল। অত্যন্ত
হালকা বলে এতদিন হাইড্রেজেন গ্যাস দিয়ে আকাশযানগুলোর উড়নশক্তির জোগান দেওয়া হত।
কিন্তু হাইড্রেজেন গ্যাস ওড়াবার পক্ষে যেমন কেজো, জ্বালাবার পক্ষে
তার চেয়ে কম না। এই গ্যাস অনেক মস্ত মস্ত উড়োজাহাজকে জ্বালিয়ে মেরেছে। হীলিয়ম
গ্যাসের মধ্যে প্রচ্ছন্ন দুরন্ত জ্বলনচণ্ডী নেই, অথচ হাইড্রেজেন
ছাড়া সকল গ্যাসের চেয়ে এ হালকা। তাই জাহাজ-ওড়ানোকে নিরাপদ করবার জন্যে তারই
ব্যবহার চলতি হয়েছে। চিকিৎসাতেও কোনো কোনো রোগে এর প্রয়োগ শুরু হল।
পূর্বেই বলা হয়েছে, পজিটিভ চার্জওয়ালা পদার্থ ও নেগেটিভ চার্জওয়ালা পদার্থ পরস্পরকে কাছে টানে
কিন্তু একই জাতীয় চার্জওয়ালারা পরস্পরকে ঠেলে ফেলতে চায়। যতই তাদের কাছাকাছি
করা যায় ততই উগ্র হয়ে ওঠে তাদের ঠেলার জোর। তেমনি বিপরীত চার্জওয়ালারা যতই
পরস্পরের কাছে আসে তাদের টানের জোর ততই বেড়ে ওঠে। এইজন্যে যে-সব ইলেক্ট্রন কেন্দ্রবস্তুর কাছাকাছি থাকে তারা টানের জোর এড়াবার জন্যে
দূরবর্তীদের চেয়ে দৌড়য় বেশি জোরে। সৌরমণ্ডলে যে-সব গ্রহ সূর্যের যত কাছে তাদের
দৌড়ের বেগ ততই বেশি; দূরের গ্রহদের বিপদ কম, তারা অনেকটা
ধীরেসুস্থে চলে।
এই ইলেক্ট্রন প্রোটনের ব্যাস সমস্ত পরমাণুর পঞ্চাশ
হাজার ভাগের এক ভাগ। অর্থাৎ পরমাণুর মধ্যে শূণ্যতাই বেশি। একটা মানুষের দেহের
সমস্ত পরমাণু যদি ঠেসে দেওয়া হয়, তা হলে তার থেকে
একটা অদশ্যৃপ্রায় বস্তুবিন্দু তৈরি হবে।
দুই প্রোটনের
পরস্পরের প্রতি বিমুখতার জোর যে কত, রসায়নী ফ্রেডরিক
সডি তার হিসাব করে বলেছেন, এক গ্র্যাম পরিমাণ প্রোটন যদি ভূতলের এক মেরুতে রাখা
যায় আর তার বিপরীত মেরুতে থাকে আর এক গ্র্যাম প্রোটন তা হলে এই সুদূর পথ পেরিয়ে
তাদের উভয়েরই ঠেলা মারার জোর হবে প্রায় ছ শো মণের চাপে। এই যদি বিধি হয় তা হলে
বোঝা শক্ত হয় পরমাণুকেন্দ্রের অতি সংকীর্ণ মণ্ডলীর মধ্যে একটির বেশি প্রোটন কেমন
করে ঘেঁষাঘেঁষি মিলে থাকতে পারে। এই নিয়ম অনুসারে হাইড্রোজেন যার পরমাণুকেন্দ্রে
একেশ্বর প্রোটনের অধিকার, সে ছাড়া বিশ্বে আর কোনো পদার্থ তো টিঁকতেই পারে না; তা হলে তো বিশ্বজগৎ হয়ে ওঠে হাইড্রোজেনময়।
এদিকে দেখা যায়
য়ুরেনিয়ম-ধাতু বহন করেছে ৯২টা প্রোটন, ১৪৬টা ন্যুট্রন। এত
বেশি ভিড় সে সামলাতে পারে না এ কথা সত্য, ক্ষণে ক্ষণে সে তার
কেন্দ্রভাণ্ডার থেকে বৈদ্যুতকণার বোঝা হালকা করতে থাকে। ভার কিছু পরিমাণ কমলে সে
রূপ নেয় রেডিয়মের, আরো কমলে হয় পলোনিয়ম, অবশেষে সীসের রূপ
ধরে স্থিতি পায়।
ওজন এত ছেঁটে ফেলেও
স্থিতি পায় কী করে এ সন্দেহ তো দূর হয় না। বিকিরণের পালা শেষ করে সমস্ত বাদসাদ
দিয়েও সীসের দখলে বাকি থাকে ৮২টা প্রোটন। পজিটিভ বৈদ্যুতের স্বজাত-ঠেলা-মারা
মেজাজ নিয়ে এই প্রোটনগুলো পরমাণুলোকের শান্তিরক্ষা করে কী করে, দীর্ঘকাল ধরে এ প্রশ্নের ভালো জবাব পাওয়া গেল না। কেন্দ্রের বাইরে ঝগড়া মেটে
না, কেন্দ্রের ভিতরটাতে এদের মৈত্রী অটুট, এ একটা বিষম সমস্যা।
এই রহস্যভেদের উপযোগী করে যন্ত্রশক্তির বল বৃদ্ধি করা হল। পরমাণুর কেন্দ্রগত
প্রোটন-লক্ষ্যের বিরুদ্ধে পরীক্ষকেরা হাঁ-ধর্মী বৈদ্যুতকণার দল লাগিয়ে দিলেন; যত জোরের বৈদ্যুতকণা তাদের ধাক্কা দিলে তার বেগ সেকেণ্ডে ৬৭২০ মাইল। তবু
কেন্দ্রস্থিত প্রোটন আপন প্রোটনধর্ম রক্ষা করলে, আক্রমণকারী
বৈদ্যুতের দলকে ছিটকিয়ে ফেললে। বৈদ্যুত তাড়নার জোর বাড়িয়ে দেওয়া হল। বিজ্ঞানী
লাগালেন ধাক্কা ৭৭০০ মাইলের বেগে, শিকারটিকে হার
মানাতে পারলেন না। অবশেষে ৮২০০ মাইলের তাড়া খেয়ে বিরুদ্ধশক্তি নরম হবার লক্ষণ
দেখালে। ছিটকানো-শক্তির বেড়া ডিঙিয়ে আক্রমণশক্তি পৌঁছল কেন্দ্রদুর্গের মধ্যে।
দেখা গেল দুটি সমধর্মী বৈদ্যুতকণা যত কাছে গিয়ে পৌঁছলে তাদের ঠেলাঠেলি যায় চুকে
সে হচ্ছে এক ইঞ্চির বহু কোটি ভাগ ঘেঁষাঘেঁষিতে। তা হলে ধরে নিতে হবে ঐ নৈকট্যের
মধ্যে প্রোটনের পরস্পর ঠেলে ফেলার শক্তি যত তার চেয়ে প্রভূত বড়ো একটা শক্তি আছে, টেনে রাখবার শক্তি। ঐ শক্তি পরমাণুমহলে প্রোটনকেও যেমন টানে ন্যুট্রনকেও তেমনি
টানে, অর্থাৎ বৈদ্যুতের চার্জ যার আছে আর যার নেই উভয়ের ‘পরেই তার সমান প্রভাব। পরমাণুকেন্দ্রবাসী এই অতিপ্রবল আকর্ষণশক্তি সমস্ত
বিশ্বকে রেখেছে বেঁধে। পরমাণুর মধ্যেকার ঘরোয়া বিবাদ মিটিয়েছে যে-শাসন সেই
শাসনেই বিশ্বে বিরাজ করে শান্তি।
আধুনিক ইতিহাস থেকে
এর উপমা সংগ্রহ ক’রে দেওয়া যাক। চীন রিপব্লিকের শান্তি নষ্ট করে
কতকগুলি একাধিপত্যলোলুপ জাঁদরেল পরস্পর লড়াই করে দেশটাকে ছারখার করে দিচ্ছিল।
রাষ্ট্রের কেন্দ্রস্থলে এই বিরুদ্ধদলের চেয়ে প্রবলতর শক্তি যদি থাকত তা হলে
শাসনের কাজে এদের সকলকে এক করে রাষ্ট্রশক্তিকে বলিষ্ঠ ও নিরাপদ করে রাখা সহজ হত।
পরমাণুর রাষ্ট্রতন্ত্রে সেই বড়ো শক্তি আছে সকল শক্তির উপরে, তাই যারা স্বভাবত মেলে না তারাও মিলে বিশ্বের শান্তি রক্ষা হচ্ছে। এর থেকে
দেখতে পাচ্ছি— বিশ্বের শান্তি পদার্থটি ভালোমানুষি শান্তি নয়।
যত-সব দুরন্তদের মিলিয়ে নিয়ে তবে একটা প্রবল মিল হয়েছে। যারা স্বতন্ত্রভাবে
সর্বনেশে তারাই মিলিতভাবে সৃষ্টির বাহন।
পরমাণুর ইতিহাসে
রেডিয়মের অধ্যায়ের মূল্য বেশি— সেইজন্যে একটু বিশদ
করে তার কথাটা বলে নিই। রেডিয়ম, লোহা প্রভৃতির মতোই
ধাতুদ্রব্য। এর পরমাণুগুলি ভারে এবং আয়তনে বড়ো। অবশেষে একদিন কী কারণে কেউ জানে
না রেডিয়মের পরমাণু যায় ফেটে, তার অল্প একটু অংশ
যায় ছুটে; এই ভাঙন-ধরা পরমাণু থেকে নিঃসৃত আল্ফারশ্মিতে যে
কণিকাগুলি প্রবাহিত হয় তারা প্রত্যেকে দুটি প্রোটন ও দুটি ন্যুট্রনের সংযোগে
তৈরি। অর্থাৎ হীলিয়ম পরমাণুর কেন্দ্রবস্তুরই সঙ্গে তার এক। বীটারশ্মি কেবল ইলেক্ট্রনের ধারা। গামারশ্মিতে কণা নেই; তা আলোক-জাতীয়।
কেন যে এমন ভাঙচুর হয় তার কারণ আজও ধরা পড়ে নি। এইটুকু অপব্যয়ের দরুন পরমাণুর
বাকি অংশ আর সেই সাবেক রেডিয়মরূপে থাকে না। তার স্বভাব যায় বদলিয়ে। দুটি ইলেক্ট্রন আত্মসাৎ
করে আল্ফাকণার পরিণতি ঘটে হীলিয়ম গ্যাসে। এই স্ফোরণ ব্যাপারকে বাইরের কিছুতে না
পারে উসকিয়ে দিতে, না পারে থামাতে। চারি দিকের অবস্থা ঠাণ্ডাই থাক্ আর
গরমই থাক্, অন্য অণুপরমাণুদের সঙ্গে মেলামেশাই করুক, অর্থাৎ তার বাইরের ব্যবস্থা যে-রকমই হোক তার ফেটে যাওয়ার কাজটা ঘটতে থাকে
ভিতরের থেকে। গড়ের উপরে রেডিয়মের আয়ু প্রায় দু হাজার বছর, কিন্তু তার যে-পরমাণু থেকে একটা আল্ফাকণা ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে তার মেয়াদ
প্রায় দিন-চারেকের। তার পরে তার থেকে পরে পরে স্ফোরণ ঘটতে থাকে, অবশেষে গিয়ে ঠেকে সীসেতে। আল্ফাকণা যখন শুরু করে তার দৌড় তখন তার বেগ থাকে
এক সেকেণ্ডে প্রায় দশ হাজার মাইল। কিন্তু যখন তাকে কোনো বস্তুপদার্থের, এমন-কি, বাতাসের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তখন দু-তিন ইঞ্চিখানেক
পথ যেতে যেতেই তার চলন সহজ হয়ে আসে। আল্ফারশ্মি চলে একেবারে সোজা রেখা ধ’রে। কী ক’রে পারে সে একটা ভাববার কথা। কেননা বাতাসে যে
অক্সিজেন বা নাইট্রেজেন পরমাণু আছে হীলিয়মের পরমাণু তার চেয়ে অনেক হালকা আর
ছোটো। এই তিন ইঞ্চি রাস্তায় বাতাসের বিস্তর ভারী ভারী অণু তাকে ঠেলে যেতে হয়। এ
কিন্তু ভিড় ঠেলে যাওয়া নয়, ভিড় ভেদ করে
যাওয়া। পরমাণু বলতে বোঝায় একটি কেন্দ্রবস্তু আর তাকে ঘিরে দৌড়-খাওয়া ইলেক্ট্রনের দল। এদের পাহারার ভিতর দিয়ে যেতে প্রচণ্ড বেগের জোর চাই। সেই
জোর আছে আল্ফাকণার। সে অন্য মণ্ডলীর ভিতর দিয়ে চলে যায়। অন্য পরমাণুর ভিতর
দিয়ে যেতে যেতে লোকসান ঘটাতে থাকে। কোনো পরমাণু দিলে হয়তো একটা ইলেক্ট্রন সরিয়ে, ক্রমে দুটো-তিনটে গেল হয়তো তার খসে, তখন ইলেক্ট্রনগুলো
বাঁধনছাড়া হয়ে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু বেশিক্ষণ নয়। অন্য পরমাণুদের সঙ্গে জোড়
বাঁধে। যে-পরমাণু ইলেক্ট্রন
হারিয়েছে তাকে লাগে পজিটিভ বৈদ্যুতের চার্জ আর যে-পরমাণু ছাড়া- ইলেক্ট্রনটাকে ধরেছে
তার চার্জ নেগেটিভ বৈদ্যুতের। তারা যদি পরস্পরের যথেষ্ট কাছাকাছি আসে তা হলে আবার
হিসেব সমান করে নেয়। অসাম্য ঘুচলে তখন বৈদ্যুতধর্মের চাঞ্চল্য শান্ত হয়ে যায়।
স্বভাবত হীলিময় পরমাণুর থাকে দুটো ইলেক্ট্রন। কিন্তু রেডিয়ম থেকে আল্ফাকণারূপে
নিঃসৃত হয়ে সে যখন অন্য বস্তুর মধ্যে দিয়ে ছুটতে থাকে তখনকার মতো তার সঙ্গী দুটো
যায় ছিন্ন হয়ে। অবশেষে উপদ্রবের অন্ত হলে ছুটো ইলেক্ট্রনদের মধ্যে থেকে অভাব পূরণ করে নিয়ে
স্বধর্মে ফিরে আসে।
এইখানে আর-একটা কথা ব’লে এই প্রসঙ্গে শেষ করে দেওয়া যাক। সকল বস্তুরই পরমাণুর ইলেক্ট্রন প্রোটন ঔ ন্যুট্রন একই পদার্থ। তাদেরই ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে বস্তুর
ভেদ। যে-পরমাণুর আছে মোট ছয়টা পজিটিভ চার্জ সেই হল কার্বনের অর্থাৎ আঙ্গারিক
বস্তুর পরমাণু। সাতটা ইলেক্ট্রনওয়ালা পরমাণু নাইট্রোজেনের, আটটা অক্সিজেনের। কেবল হাইড্রেজেন পরমাণুর আছে একটা ইলেক্ট্রন। আর বিরেনব্বইটা আছে য়ুরেনিয়মের।
পরমাণুদের মধ্যে পজিটিভ চার্জের সংখ্যাভেদ নিয়েই তাদের জাতিভেদ। সৃষ্টির সমস্ত
বৈচিত্র্যই সংখ্যার ছন্দে।
বৈদ্যুতসন্ধানীরা
যখন আপন কাজে নিযুক্ত আছেন তখন তাদের হিসাবে গোলমাল বাধিয়ে দিয়ে অকস্মাৎ একটা
অজানা শক্তির অস্তিত্ব ধরা দিল। তার বিকিরণকে নাম দেওয়া হল মহাজাগতিক-রশ্মি; কস্মিকরশ্মি। বলা যেতে পারে আকস্মিক রশ্মি। কোথা থেকে আসছে বোঝা গেল না
কিন্তু দেখা গেল সর্বত্রই। কোনো বস্তু বা কোনো জীব নেই যার উপরে এর করক্ষেপ চলছে
না। এমন-কি; ধাতুদ্রব্যের পরমাণুগুলোকে ঘা মেরে উত্তেজিত ক’রে দিচ্ছে। হয়তো এরা জীবের প্রাণশক্তির সাহায্য করছে, কিংবা বিনাশ করছে— কী করছে জানা নেই, আঘাত করছে এইটেই নিঃসংশয়।
এই-যে ক্রমাগতই কস্মিকরশ্মি-বর্ষণ
চলেছে এর উৎপত্তির রহস্য অজানা রয়ে গেল। কিন্তু জানা গেছে বিপুল এর উদ্যম, সমস্ত আকাশ জুড়ে এর সঞ্চরণ, জলে স্থলে আকাশে
সকল পদার্থেই এর প্রবেশ; এই মহা আগন্তুকের পিছনে বিজ্ঞানের চর লেগেই আছে, কোন্ দিন গোপন ঠিকানা ধরা পড়বে।
অনেকে বলে কস্মিক
আলো আলোই বটে, র্যন্ট্গেন রশ্মির চেয়ে বহুগুণে জোরালো। তাই এরা
সহজে পুরু সীসে বা মোটা সোনার পাত পার হয়ে চলে যায়। বিজ্ঞানীদের পরীক্ষায় এটুকু
জানা গেছে এই আলোর সঙ্গে আছে বৈদ্যুতকণা। পৃথিবীর যে ক্ষেত্রে চৌম্বকশক্তি বেশি
এরা তারই টানে আপন পথ থেকে সরে গিয়ে মেরুপ্রদেশে জমা হয়, তাই পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় কস্মিক রশ্মির সমাবেশের কমিবেশি দেখা যায়।
কস্মিকরশ্মির
সম্বন্ধে এখনো নানা মতের আনাগোন চলেইছে। পরমাণুর নূতন তত্ত্বের সূত্রপাত হওয়ার পর
থেকেই বিজ্ঞানমহলে মননের ও মতের তোলাপাড়ার অন্ত নেই, বিশ্বের মূল কারখানার ব্যবস্থায় ধ্রুবত্বের পাকা সংকেত খুঁজে বের করা অসাধ্য
হল। নিত্য ব’লে যদি কিছু খ্যাতি পেতে পারে তবে সে কেবল এক
আদিজ্যোতি, যা রয়েছে সব-কিছুরই ভূমিকায়, যার প্রকাশের নানা অবস্থান্তরের ভিতর দিয়ে গড়ে উঠেছে বিশ্বের এই বৈচিত্র্য।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন